শুক্রবার, ১৭ এপ্রিল, ২০০৯

গোর্খাল্যান্ড ৩ - পারিজাত ভট্টাচার্য্য


পর্ব -৩:

গ্রেটার ণেপাল ও গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন:

অনেকেই ভেবেছিলেন যে নেপাল এ মাওবাদীরা ক্ষমতায় আসলে, নেপাল এর সাথে আমাদের দেশের সু-সম্পর্ক থাকবে না, ওরা খালি চিন-চিন করবে আর ভারত এর সাথে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করবে, যাতে ভারত তারাহুড়ো করে উল্টো-পাল্টা কিছু করে বসে। কিন্ত এমনটা কিছুই হয়নি। প্রচন্ড এবং সাথে আরো অনেকেই দিল্লী তে আলোচনা করে গেছেন , ভালোভাবেই আলোচনা হয়েছে। আমাদের দেশের সাথে যাতে নেপাল এর সম্পর্ক ভালো না থাকে তার জন্যে কিছু কিছু দেশ সচেষ্ঠ। কোনো কোনো দেশ ভারতে নাশকতা মুলক কাজ পরিচালনা করার জন্যে নেপাল কে ঘাটি হিসেবে গড়ে তুলতে সক্রিয়। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যেমন দেশে দেশের আভ্যন্তরিন ব্যাপারে নাক গলাতে অভ্যস্ত, ঠিক তেমনি ভাবেই তারা নেপালের আভ্যন্তরিন রাজনীতিতে হস্থখেপের তাল খুঁজে বেড়াচ্ছে। ওদের একটাই লক্ষ্য--মাওবাদী। তাই তাদের খতম করতে, এবং নেপাল দেশে নানারকম অস্থিরতা তৈরি করতে, ওরা নেপাল এর অভ্যন্তরে নানারকম বিচ্ছিন্নতাকারী শক্তি দের মদত যুগিয়ে আসছে। বর্তমানে নেপালে রাজা নেই, মাওবাদীরা সরকারে আসীন অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির সাথে। কিন্ত এই নতুন বাস্তবতা মেনে নিতে রাজি নয় আমেরিকা, তাই ওনারা নানান তালে আছেন। এই আমেরিকা ভালই বোঝে যে ভারত এবং চিন এর মাঝে নেপাল দেশটিরভৌগোলিক অবস্থানের প্রাধান্য, তাই তাদের এত লম্ফ-ঝম্ফ।

নেপাল দেশটি গঠন এবং আর্থসামাজিক অগ্রগতির দিক দিয়ে মোটামুটি চার ভাগে বিভক্ত:

১) প্রথম ভারতবর্ষের সীমানা পার্শবর্তী ত্বরাই অঞ্চল। দক্ষিন দিক। সাধারণভাবে সমতল এবং ঊর্বর। এটাই নেপাল দেশের শস্যভান্ডার।
২) ত্বরাই এর উত্তরে সিবালিক। ছোটো, মাঝারী পর্বতমালার মধ্যে সবথেকে উচু পর্বতমালা ১৫০০ মিটার এর মধ্যে। সিবালিক এর পরে মহাভারত রেঞ্জ, এখানে পর্বতমালার উচ্চতা ৩০০০ মিটার অবধি। এই এলাকাতে অনেক মানুষ থাকে।
৩) এর উত্তরে উপ্যতকা বা ভ্যালি। খুব উর্বর এবং ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। এখানে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু অবস্থীত।
৪) এর উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা। এখানে এভারেস্ট, কাঞ্চঞ্জঙ্ঘা, সবই অবস্থীত।

নেপাল এর অর্থনীতিতে শুধু নয়, এখন সেখানকার রাজনীতিতের ওই ত্বরাই অঞ্চল বিশেষ দৃষ্ঠি আকর্ষণ করেছে। এখানে অনেক বড় সঙ্খ্যার মানুষ বাস করেন এবং এদের বেশি ভাগ’ই হচ্ছে ভারতের বংশদ্ভূত। মাওবাদীরা অন্যত্র বেশি দাপাদাপী করলেও এই অঞ্চলে বেশী সুবিধে করতে পারে না, বরং ত্বরাইভিত্তিক দুইএকটি দল তৈরী হয়েছে যাদের শক্তি এখানে অনেক বেশী, এই এলাকাতে ভোটে এরাই সঙ্খ্যাগরিষ্ঠ। মাওবাদীরা এদের হাথে নিয়মিত মার খায়। সাধারনত এদের মধেশীয় বলা হয়। এদের একটা অংশ ত্বরাই কে নেপাল থেকে বিচ্ছিন্ন করার নীতিতে বিশ্বাসী এবং উদ্যোগী। এদের আরেকটা অংশ যথেষ্ঠ ক্ষমতা নিয়ে স্বাশন চালায় নেপাল এর মধ্যেই। এদের সাথে সমঝতা না করে নেপালে সাধারণ নির্বাচন করা যাচ্ছিল না।


ঐ মধেশীয় নেতা কে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়। নানারকম প্রশ্নে ওই ত্বরাই এর রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সাথে সমঝতা করে চলতে হচ্ছে নেপাল সরকারকে। সি পি আই (এম) এর কোয়েম্বাটোরে, ১৯ তম পার্টি কংগ্রেসে, এই পরিস্থিতি বিশ্লেশণ করে বলা হয় যে, এর মধ্যে ত্বরাই অঞ্চলে জঙ্গি মধেশীয় আন্দোলন গড়ে ঊঠেছে যারা ভবিষৎএ সমস্ত সরকারী গনতান্ত্রিক মঞ্চে প্রতিনিধিত্ব করার দাবি তুলেছে। গনতন্ত্রে উত্তরণের শক্তি প্রক্রিয়াকে বিপথে পরিচালিত করতে এই ঘটনাকে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি, জনজীবনে বিভাজন ঘটানোর লক্ষ্যে ব্যাবহার করে চলেছে। এমনিতেই ত্বরাই নেপালের সিঙ্ঘদুয়ার, অন্যতম প্রধান উন্ন্যত এলাকা। ওই দেশে শিল্প যা আছে, তার প্রধান অংশ ওই ত্বরাইতে। এর সাথে নেপাল এর রাজনীতিতে ত্বরাইএর সজোর হস্তক্ষেপ, একটা বিশেষ মাত্রা যোগ করেছে। অবশ্য নেপাল এর অভ্যন্তরে অনেক কাল ধরে ভারত বিরোধী শক্তি সক্রিয়। নানান ছুতোয়, তারা ভারত-নেপাল সম্পর্ক খারাপ করতে চায়। এরকম ই একটা শক্তি গ্রেটার নেপাল এর দাবিতে সোচ্চার।

ভারতের সাধারণতন্ত্র দিবসে এরা কাঠমান্ডু তে ভারতীয় দূতাবাসের সামনে গ্রেটার নেপাল ফেরানোর দাবিতে শামিল হয়ে বিক্ষোভ দেখিয়েছিল। ১৮১৬ তে ব্রিটিশ এর সাথে নেপাল এর চুক্তি অনুযায়ী, এদের দাবীমত হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাঞ্চল, সিকিম, পশ্চিম বঙ্গের দার্জিলিং জেলা (শিলিগুড়ি নিয়ে) অনেকটা এলাকা নেপাল এর হাত থেকে ব্রিটিশের হাতে চলে যায়। ভারত স্বাধীন হবার পরে ১৯৫০ সালে নেপাল এর সাথে চুক্তি হয়। ওদের বক্তব্য, পুরনো ব্রিটিশদের চুক্তির কোনো অর্থ নেই, অথহেব, ২০০ বছর আগের সব জায়গা ফেরত দাও, আর না ফেরত দিলে, ওদের এক নেতার কথায়, কাশ্মীরের থেকেও বেশী আগুন জ্বলবে এই সব দাবির অঞ্চলে। ওদের এক নেতার কথায়...” I have visited these areas and found that Nepalese of Indian origin as well as Nepalese forced to seek menial jobs in India support the demand”...গ্রেটার নেপাল গড়ার উদ্দেশ্যে গড়ে উঠেছে ইউনিফাইড নেপাল ন্যাসানাল ফ্রন্ট (UNNF), এই ফ্রন্ট এর পক্ষ্য থেকে ২০০৮ সালে গ্রেটার নেপাল এর ম্যাপ প্রকাশিত করা হয় আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং ইংল্যান্ড এর রানীর কাছে দাবীসনদ পেশ করা হয়।

গ্রেটার নেপাল এর ম্যাপ এ পশ্চিমবঙ্গ( শিলিগুড়ি এবং ডুয়ার্স নিয়ে) আর গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে জঙ্গি আন্দোলনকারী হুমকি দেওয়া গষ্ঠির ম্যাপ, কাকতালীয় ভাবে এক। গ্রেটার নেপালের প্রবক্তাদের মূল কথা হচ্ছে, ১৮১৬ সালের সুগাউলি চুক্তি বে-আইনি, জোর করে ব্রিটিশ নেপালের কাছ থেকে এলাকা নিয়ে নিয়েছিল, এখন ব্রিটিশ চলে গেছে, তাই ভারতকে নেপালের জায়গা ফেরত দিতে হবে। অর্থাৎ মামলা ভারতের মধ্যে শুধু আলাদা গোর্খল্যান্ড রাজ্য নয়, ভারত থেকে বেরিয়ে নেপালে যুক্ত হওয়া। মামলা শুধু দার্জিলিং , শিলিগুড়ি, আলিপূরদুয়ার দেওয়া নয়, সিকিম, উত্তরাঞ্চল দিয়ে দেবার। তাই গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে যারা লড়ছেন এবং যারা সমর্থন করছেন, তাদের গ্রেটার নেপাল সম্পর্কে বক্তব্য কি?.........

দীর্ঘ আন্দোলন, রক্তপাত এবং ততধিক আলাপ-আলোচনার শেষে, রাজীব গান্ধী, জ্যোতি বসু, সুভাষ ঘিসিং তৈরি করলেন DGHC । তবে এটাও ঠিক যে সুভাষ ঘিসিং রা যতটা কাজ করতে পারতেন ওই এলাকাতে, তার প্রায় কিছুই হয়নি, DGHC গঠন হবার পরে প্রথম কয়েক বছর খুব ভাল কাজ হলেও, শেষ দেড় দশক কিছুই হয় নি। যে মুহুর্তে ঘিসিং দেখলেন (প্রায় ২০ বছর ডি জি এইচ সি চালাবার পরে), কাউন্সিল এর ভোট এগিয়ে এসেছে এবং ওনার জনসমর্থন তলানিতে ঠেকেছে, তখন হুঙ্কার ছাড়লেন... ষষ্ঠ তপশীল। সরকার পাহাড়ে পুনরায় অশান্তী ঠেকাতে যখন ষষ্ঠ তপশীল এর প্রসঙ্গে নীতিগতভাবে মেনে নিতে রাজি হলো, তখন দার্জিলিং এ বিজয় মিছিল বেরোলো। এই বিমল গুরুং নেত্রীত্ব দিলেন। হঠাৎ কি হলো, কয়েকদিনের মধ্যে সব উলটে পালটে গেলো। “ডি জি এইচ সি চাই না, ষষ্ঠ তপশীল চাই না, চাই আলাদা রাজ্য...গোর্খাল্যান্ড, চাই শিলিগুড়ি শুদ্ধু ডুয়ার্স”। কেউ যদি ভালো করে লক্ষ্য করেন তাহলে বুঝবেন যে, পাহাড় নিয়ে আলাদা রাজ্য “গোর্খাল্যান্ড” গঠনের চেয়ে বেশি নজর শিলিগুড়ি সমেত ডুয়ার্সে বেশি গন্ডগোল পাকানো। দার্জিলিং, কার্সিয়াং, কালিম্পং এ সভা করার থেকে বেশি স্বার্থ এবং চেষ্ঠা, শিলিগুড়ি, মালবাজার আর বানারহাটে সভা করার। যেকনো ভাবে ডুয়ার্সে গন্ডগোল পাকানো। তাই প্রশ্ন শুধু বাংলা ভাগের নয়, আমাদের দেশে কে দূর্বল করার চক্রান্ত আরো গভীর হচ্ছে। অনেক দেশী-বিদেশী শক্তি হাত মিলিয়ে এই চক্রান্তের মধ্যে আছে।
...শেষ
গোর্খাল্যান্ড পর্ব ২
গোর্খাল্যান্ড পর্ব ১

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন