শুক্রবার, ২ নভেম্বর, ২০১২

সুকুমার ~ অমিতাভ প্রামাণিক

যে কোন বালখিল্যের কাছে ফটোগ্রাফি একটি অত্যন্ত সহজ কার্য। প্রয়োজন একখানি ক্যামেরার। সে তাহাকে বাগাইয়া ধরিয়া সম্মুখে উপস্থিত কোন প্রাণী বা প্রকৃতির অংশবিশেষকে তাক করিয়া প্রবল উৎসাহের সহিত শাটার টিপিয়া দেয়। ব্যাস, ক্যামেরাটি ডিজিট্যাল হইলে – আর সম্প্রতি সকল ক্যামেরাই ডিজিট্যাল – ছবি প্রস্তুত। ক্যামেরার লেন্সটির সম্মুখে ঢাকনা থাকিলে উহা খুলিয়া শাটারটি টিপিলে সাধারণতঃ ছবিটির উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ যে কেহই ফটোগ্রাফার হইতে পারে, কোন অসুবিধা নেই।

হায়, ট্যাঁশগরু গরু নয়, সব কবি কবি নয়, ফটো তুলিলেই ফটোগ্রাফার হওয়া সম্ভব নহে।

কিন্তু না, ফটোগ্রাফি সম্বন্ধে জ্ঞানদানের কোন অভিপ্রায় আমার নাই, চারি অক্ষরের এই শব্দটির প্রথমস্থ ফ'ও আমি জানি না। এতদ্‌সত্ত্বেও কোন বাল্যকালে পাঠ করিয়াছিলাম, 'আয় তোর মুণ্ডুটা দেখি, আয় দেখি ফুটোস্কোপ দিয়ে', আর ইহা আমার অবচেতন মনের অনেকগুলি কক্ষে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করিয়া লইয়াছে, তাহা হলফ করিয়া বলিতে পারি।

'আবোল তাবোল' কাব্যগ্রন্থে যখন ইহা পাঠ করিয়াছিলাম, অল্পবয়স্ক হইলেও বুঝিয়াছিলাম ফুটোস্কোপ বলিয়া কিছু নাই, আর মুণ্ডুর অভ্যন্তরস্থ কিছু অবলোকন করিবার জন্য তদ্‌সন্নিহিত ছবিটির ন্যায় কোন যন্ত্র নিতান্তই অক্ষম। নির্মল হাস্যরস ঐ পুস্তকের সকল কবিতার উপাদান। বাংলা সাহিত্যে এই ধরণের কবিতার সম্ভবত ইহাই প্রথম উদাহরণ। অদ্যাবধি ইহার সার্থক কোন উত্তরাধিকারীও বোধ হয় আসে নাই। ক্ষণজন্মা সুকুমার রায় মাত্র ছত্রিশ বৎসর বয়সে পরলোকগমন করেন। আরও ছত্রিশ বৎসর কবিতা রচনা করিতে পারিলে তাঁহার কলম হইতে কী উৎসারিত হইত, তাহা যথেষ্ট ভাবনার অবকাশ রাখে।

কবি নিজে ইহার ধরণকে খেয়াল রস বলিয়াছিলেন, আবোল তাবোল গ্রন্থের মুখবন্ধে এক কৈফিয়তে তিনি ইহা সর্বজনগ্রাহ্য নাও হইতে পারে বলিয়া সংশয় প্রকাশ করিয়াছিলেন। এখন ইহাকে 'ননসেন্স' বলা হয়, বাংলায় কী বলিব, আজগুবি? সুযোগ্য পুত্র সত্যজিৎ 'সুকুমার সমগ্র' প্রকাশকালে ইহার ভূমিকায় পিতার রচনার অত্যন্ত মনোগ্রাহী আলোচনা ও বিশ্বসাহিত্যের প্রেক্ষিতে ইহার মূল্যায়ন করিয়াছেন।

আবোল তাবোলের প্রতিটি কবিতাতেই হাস্যরস, ছন্দমাধুর্য ছাড়াও অসাধারণ সৃজনশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়। 'খিচুড়ি'তে দুই প্রাণীর সংমিশ্রণে – যাহাদের নামের শেষ ও প্রথম অংশ সমান – উদ্ভট নতুন প্রজাতির কল্পনা, তাহাদের নাম হাঁসজারু, বকচ্ছপ, গিরিগিটিয়া, হাতিমি, বিছাগল, মোরগরু, জিরাফড়িং। 'সৎপাত্রে' এমন এক পাত্রের অবতারণা, যাহার সহিত নিজের কন্যার বিবাহের প্রস্তাব হাস্যকরেরও অধিক। 'গোঁফচুরি'তে রহস্যময় অঙ্গহানি, 'কাঠবুড়ো'তে বিচিত্র কাষ্ঠতত্ত্ববিদ সৃষ্টি, 'খুড়োর কল' ও 'বিজ্ঞান শিক্ষা'য় অদ্ভুত প্রযুক্তির উদ্ভাবনা, 'কুমড়োপটাশ' ও 'হুঁকোমুখো হ্যাংলা'য় আবার মনুষ্যবৎ আজব নতুন প্রাণীর বর্ণনা।

প্রশ্ন করা যাইতেই পারে, প্রায় এক শতাব্দী হইতে চলিল, ইহার পুনর্নিমাণ সেই প্রকার কেন হইল না? হাস্যরসের চর্চা যে মনুষ্যসকল বন্ধ করিয়া দিয়াছে, তাহা নহে। রম্যরচনা বলিয়া সাহিত্যের একটি নতুন ধারা সৃষ্টির প্রয়াস অনেক কালের। ছন্দ লইয়া অনেকেই গবেষণা করিয়াছেন। কবিতা তো কিছু শব্দসমষ্টি লইয়াই গ্রথিত, বাংলা শব্দভাণ্ডার দিন দিন পুষ্ট হইতেছে অন্যান্য ভাষা হইতে শব্দ গ্রহণ করিয়া। তবু নির্ভেজাল সুকুমারী হাস্যরসের পরবর্তী উদাহরণ খুঁজিতে গেলে ফুটোস্কোপের কেন প্রয়োজন?

'শব্দকল্পদ্রুমে' বৃহস্পতির মন্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত দশটি লাইনের প্রথম দুই ও শেষ দুই লাইন লইয়া দ্রিঘাংচু-র মন্ত্র। দ্রিঘাংচু'র চার লাইন বহুল প্রচলিত, সমগ্র দশ লাইন হয়তো নয়। স্মরণ করিয়া দেওয়া যাউকঃ 

হলদে সবুজ ওরাং ওটাং
ইঁট পাটকেল চিৎপটাং
গন্ধগোকুল হিজিবিজি
নো অ্যাডমিশন ভেরি বিজি
নন্দী ভৃঙ্গী সারেগামা
নেই মামা তার কানা মামা
চিনে বাদাম সর্দি কাশি
ব্লটিং পেপার বাঘের মাসি
মুশকিল আসান উড়ে মালি
ধর্মতলা কর্মখালি

এই মন্ত্র প্রসঙ্গে সত্যজিৎ বলিয়াছেনঃ 'খাঁটি ননসেন্সের এর চেয়ে সার্থক উদাহরণ পাওয়া মুশকিল। কোথায় বা কেন যে এর সার্থকতা, এই অসংলগ্ন অর্থহীন বাক্যসমষ্টির সামান্য অদল বদল করলেই কেন যে এর অঙ্গহানি হতে বাধ্য, তা বলা খুবই কঠিন। এর অনুকরণ চলে না, এর বিশ্লেষণ চলে না এবং জিনিয়াস ছাড়া এর উদ্ভাবন সম্ভব নয়'।

সম্ভবতঃ এই শেষ বাক্যটিই সুকুমারী হাস্যসাহিত্যের অগ্রগতির অন্তরায়। রবীন্দ্র-পরবর্তী সময়ে সত্যজিৎসহ বহু সাহিত্যিক শিশুসাহিত্য রচনা করিয়াছেন, অনেকেই অত্যন্ত গুণী ও সফল। কিন্তু তাঁহারা কেহই সম্ভবতঃ সুকুমারের উত্তরসূরী নহেন।

বালখিল্যের ফটোগ্রাফি দিয়া শুরু করিয়াছিলাম। বালখিল্যের ন্যায় আমিও ভাবিয়াছিলাম – ইহা আর এমন কী, এমন মন্ত্র রচনা করিতে আমিও সক্ষম। বস্তুতঃ চার লাইন বানাইতে বেশি সেকেণ্ড সময় ব্যয় হয় নাই, লিখিলাম – 

ভিজে গামছা চিটেগুড়
পাটলিপুত্র মধুপুর
বুড়ো হাবড়া সরু থোড়
গা ছমছম গরুচোর 

কিন্তু ফুটোস্কোপ ছাড়াই স্পষ্ট প্রতীয়মান যে, ইহা একটি অন্ধ অনুকরণ মাত্র, ইহাতে বিন্দুমাত্র নিজস্বতা নাই। নিজস্বতা ব্যতিরেকে হাওয়াই চটি সেলাই চলিতে পারে, সাহিত্য রচনা সম্ভব নয়।

ফটোগ্রাফি সম্বন্ধে একটি প্রাসঙ্গিক তথ্য ব্যক্ত করিয়া অদ্যকার আলোচনায় ইতি টানিব। সুকুমারের পিতা উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন তৎকালীন ভারতবর্ষে ফটোগ্রাফি শিল্পের এক উজ্জ্বল তারকা। তাঁহার 'পিন হোল থিয়োরি'র উপর এক অসাধারণ প্রবন্ধ ব্রিটিশ জার্নাল অফ ফটোগ্রাফিতে প্রকাশিত হইয়াছিল ১৯১৩ সালে, রবীন্দ্রনাথ যে বৎসর নোবেল পুরস্কার লাভ করিয়াছিলেন। এই সম্মানে ভূষিত একমাত্র ভারতীয় ছিলেন উপেন্দ্রকিশোরই।

1 টি মন্তব্য:

  1. লেখাটি অত্যন্ত ভালো লাগলো। বিশেষ করে ভালো লাগলো দু খানি লজিনিষ। এক, সুকুমার রায়ের ফোটোগ্রাফি চর্চা। তিনি নিজে ছিলেন রয়্যাল ফোটোগ্রাফিক সোসাইটির ফেলো মেম্বার। বিলেতে কয়েক বছর থেকে, আধুনিক ফোটোগ্রাফি সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করেন সুকুমার রায়। আর দু নম্বর যেটা ভালো লাগলো, সেটা হলো, ওনার মতো করে অনুকরন করে লেখার প্রচেষ্টা। সেটা কিছুতেই আসল হতে পারে না। খুব ভালো লাগলো, আপনার কাছ থেকে আরো লেখা পাবার আশায় রইলাম আমরা।

    উত্তরমুছুন