শুক্রবার, ৯ আগস্ট, ২০১৩

সরিফুল ~ অমিতাভ প্রামাণিক

পৃথিবীর আকাশে কোথাও না কোথাও আজ চাঁদ দেখা গেছেই। পবিত্র রমজানের শেষে আজ খুশির ঈদ। আজ উৎসবের দিন, আনন্দের দিন আজ, আজ সকলের সঙ্গে মিলে সুখ বিতরণের দিন।

সরিফুলকে মনে পড়ল আজ। সরিফুল ইসলাম। ইস্কুলে আমরা এক ক্লাশে পড়তাম। ও এখন কোথায় থাকে, কী করে, কিচ্ছু জানি না।

সেটা বোধ হয় ক্লাশ সিক্স কিম্বা সেভেন। মাধ্যমিক অবধি আমার সুবিধা ছিল, যে ক্লাশে পড়তাম সেটা সেভেন্টি সেই ইয়ার, মানে নাইন্টি সিক্স-সেভেনের ঘটনা। আমার বয়স দশ কি এগার। রোগে ভুগে ভুগে ঘ্যানাপটকা চেহারা, বন্ধুরা বলত ঝ্যাঁটার কাঠির মাথায় ভাটাম ফল। কিন্তু সেটাও ঠিক না, পেটভর্তি পিলে, হাঁটলে আমার চেয়ে আমার পেটটা আগে আগে চলত, অনেকটা ভোডাফোনের জুজুদের মত।

বাবা ভোরবেলা গীতাপাঠ করত বলে মুখে মুখে সংস্কৃত শব্দ কিছু শেখা হয়ে যেত। বন্ধুবান্ধবদের নামের কী মানে, তার কী ব্যুৎপত্তি, এসব নিয়ে মাথা ঘামাতাম। শুভব্রত চিউইঙ্গাম (তখন চুনকাম বলতাম) খেয়ে কারো চুলে লাগিয়ে দিলে বলতাম, তোর ব্রত মোটেও শুভ নয়। উৎপলের হাসিটা ছিল ফোটা পদ্মের মত, প্রভাতের নাম আঁধার হলেই যেন বেশি মানাতো, মলিনও ওর নামের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। আমি আমার অপরিসীম দ্যুতি দিয়ে ক্লাশ ভরিয়ে রাখতাম, অনেক সময়েই সেই দ্যুতির উৎস ছিল রোগের জীবাণু।

সরিফুলে এসে হোঁচট খেলাম। সরিষার ফুল হলে তাও এক রকম, কিন্তু সরিফুল কথার অর্থ কী? সরিফুলকে জিজ্ঞেস করলে ও উত্তর দিতে পারত না। নামের অর্থ নিয়ে ওর কোন মাথাব্যথা ছিল না। আমি একে ওকে জিজ্ঞেস করতাম, এই, সরিফুল মানে কী রে?

ক্লাশেরই একজন, কে মনে নেই, আমাকে ডেকে নিয়ে কানে কানে ফিসফিস করে বলল, সরিফুল নেড়ে তো, নেড়েদের নামের মানে থাকে না। আমি বললাম, নেড়ে কী? ও বলল, জোরে বলিস না, শুনলে তোকে ধরে যা দেবে না!

অসভ্য গালাগালি আমাদের পাড়ায় লেগেই থাকত, শুনলেই বুঝে যেতাম কোনটা বলা উচিত আর কোনটা অনির্বচনীয়। দ্বিতীয়টার তালিকায় একটা নতুন শব্দ যোগ হল – নেড়ে! কিছুদিন পরে জানলাম, নেড়ে মানে মুসলমান। কালোদের যেমন কালো বলতে নেই, পাগলদেরও তাই, তেমনি মুসলমানদের কিছু কিছু শব্দ বললে অসম্মান করা হয়।

বন্ধুদের মধ্যে আবার মান-সম্মান! মাসখানেক পরেই ইস্কুলের পেছনের মাঠে ক্যাম্বিস বল দিয়ে কিরিং কিরিং খেলা হচ্ছিল টিফিন পিরিয়ডে। আমি ভাত খেয়ে ইস্কুলে যাই, টিফিনের বালাই নেই। পার্থ তাও প্রায় রোজ আমাকে কিছু না কিছু খাওয়াত। ঘুগনি, আলুকাবলি বিক্রি হত গেটের ঠিক বাইরেই। আর ছিল দুধ আইস্ক্রীম। মিষ্টি বরফের সিলিন্ডারে কাঠি ঢোকানো, তার মাথায় কোরানো নারকেল। আহ্‌, অমৃত। এই সব খাওয়ানোর বদলে আমি পার্থকে বইয়ের পেছনের কোশ্চেনের উত্তর লিখে দিতাম। সেই পার্থ সেদিন আসেনি, আমি তাই কিরিং কিরিং-এ ভিড়ে গেলাম। খেলাধূলায় আমার উৎসাহ কম, ছোটাছুটি করতে পারি না, রোগে ভোগা নিস্তেজ শরীর। কিরিং কিরিং-এ অনেক ছুটতে হয়, কেননা অপোনেন্টের কেউ কাছে থাকলেই সেই ক্যাম্বিস বল ছুঁড়ে মারবে। গায়ে লাগলেই আউট। হয় বলের গতিপথ থেকে সরে গিয়ে নিজেকে বাঁচাও, অথবা হাতে
চটি পরে নাও, সেই চটি দিয়ে বলটা ডিফ্লেক্ট করে দাও। শুধু চটিতে লাগলে আউট না।

সরিফুল আর আমি আলাদা দলে। খেলার মধ্যে কোন এক সময় সরিফুলের হাতে বল এল, আমি ওর নাগালের মধ্যেই। সরিফুল আমাকে মারতে গেল, চটি পরা হাতে আমি চিৎকার করে বললাম, জোরে মারিস না। কে শোনে কার কথা। সরিফুল গায়ের জোরে বল ছুঁড়ল, লাগলো আমার ঠিক চোখের নীচে। কালশিটে পড়ে গেল মুহূর্তে। মানে, বাড়ি গিয়ে মার হাতে আবার ঠ্যাঙানি খেতে হবে।

ক্লাশে বন্ধুবান্ধব যখন ফেরত গেলাম, আর আমার জিগ্‌রি দোস্তরা, যারা কিরিং কিরিং খেলছিল না, আমাকে জিজ্ঞেস করল, কে সেই পাষন্ড যে আমার এই হাল করেছে, যেন নাম বলে দিলেই ওরা গিয়ে তাকে কীচকের মত বধ করবে, আমি সরিফুলের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললাম, ওই নেড়েটা!

সরিফুল এমনিতেই একটু অপ্রস্তুত ছিল – কারো লেগে যাক কেউই চায় না – যদিও খেলতে গিয়ে অনেক কিছুই হত, এ তো কিছুই না। কিন্তু আমার ওই অপভাষণ শুনে ওর মুখ সাদা হয়ে গেল। ওর চোখে আমি জ্বলন্ত ঘৃণার অভিব্যক্তি দেখলাম। বহু মাস সরিফুল আমার সাথে কথা বলেনি।

মাত্র কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত গোলাম মুরশেদের লেখা হাজার বছরের বাঙালির সংস্কৃতি বইটা পড়তে পড়তে জানলাম, বাঙালি মুসলমানদের পূর্বপুরুষ অনেকেই ছিল বৌদ্ধভিক্ষু, তাদের ন্যাড়া মাথা, সেই থেকে নেড়ে শব্দটা এসেছে। অ্যাজ ইফ, যারা ওদের নেড়ে বলছে, তাদের পূর্বপুরুষরা নেড়ে ছিল না! শুধু নেড়ে না, ওদের যবন, ম্লেচ্ছ ইত্যাদি আরো অনেক কিছু বলা হয়, বদলে ওরা বলে, কাফের!

এই সব শব্দ বাতাসে ধ্বনিত হলেই মহাসিন্ধুর ওপারে বজ্রনির্ঘোষের মত পাপ-তাপ জেগে ওঠে। মানুষ তখন আর মানুষ থাকে না।

শুধু সরিফুল না, আমাদের আরো কয়েকজন মুসলমান বন্ধু ছিল। রোজার সময় অনেকে ওদের একটু সহানুভূতির চোখে দেখত। আহা, বেচারিরা সারাদিন না খেয়ে থাকে। আমি এই জিনিসটা খুব ভাল বুঝতাম না। আমার তো হাজারটা রোগ। কিছু খাওয়ার আগে ওষুধ, পরে ওষুধ খেতে হত বলে খাওয়া জিনিসটাই পছন্দ করতাম না, খিদে তেষ্টাও বিশেষ ছিল না। তাছাড়া বাড়িতে মা-ঠাকুমা হরদম উপোষ করত। আজ বারের পুজো, কাল সন্তোষী মা, পরশু একাদশী, উপোষের ঘনঘটা। কেউ দিনের বেলা না খেয়ে আছে জানলে আমার তেমন কোন বিশেষ অনুভূতি হত না।

পরে জেনেছিলাম, ওদের অনেকেরই এমনিতেই দুবেলা খাবার জুটত না। রোজার মাসটা ধর্মপালনের নামে চলে যেত বেশ। অন্যসময়ও খাবার রুটিন খুব বেশি পাল্টাতো না। ক'বছর আগে ওদের বেশ কিছু আত্মীয়স্বজন 'ওপারে' চলে গেছে, নতুন বাংলাদেশে। ওদের তাই খুব কষ্টে দিন কাটে।

রোজার পর অবশ্যম্ভাবী চলে আসত ঈদ। ইস্কুল ছুটি থাকত। আমরা শুনতাম, আমাদের যেমন দুর্গাপুজো, ওদের তেমনি ঈদ। কিন্তু কই, আমাদের যে পুজোয় প্যান্ডেল হয়, চার-পাঁচ দিন হৈ-হুল্লোড়, মাইক বাজে, বাজিপটকা ফাটে, ঠাকুর আসে, ঠাকুর যায়, আমরা নতুন জামাকাপড় পরে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘুরি, ওদেরও ডাকি, আয়, ওরা তো আমাদের ডাকে না!

যাদের নিজেদেরই দুবেলা দুমুঠো জোটে না, তারা কাদের ডাকবে! আমাদের চরমতম শত্রুর নাম দারিদ্র্য।

দারিদ্র্য বেড়ে যায় যত আমরা নিজেদের খন্ড-ক্ষুদ্র করি। যত বেশি ভেদাভেদ, তত দরিদ্রতা বেশি। এটা বুঝি না বলেই আমরা পূর্ব-পশ্চিম, ঘটি-বাঙাল, হিন্দু-মুসলমান, উচ্চ-নীচ! আর যতই চিল্লামিল্লি করি, পরিসংখ্যান বলে, পৃথিবীর দরিদ্রতম অঞ্চলগুলির একটা হচ্ছে এই গঙ্গা-পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা।

আমি কোরাণ বা বেদ কিছুই পড়িনি, মুসলমান-হিন্দুর ব্যাপারটা এখনও বুঝি না। বইগুলো পড়া ভালো, অনেকে অনেক বছর চিন্তাভাবনা করে লিখেছেন, নিশ্চয় তার গুরুত্ব আছে। কিন্তু ভেবে দেখুন, আমাদের সভ্যতার ইতিহাস মাত্রই সাড়ে তিন-চার হাজার বছরের, আর এসব লেখা দেড়-দু হাজার বছর বা তারও আগে। এসব আঁকড়ে ধরে নিজেদের ভাগাভাগি করে সামনের দিকে কী করে চলতে পারি আমরা?

সরিফুল কাছাকাছি থাকলে আজ নিশ্চয় ডেকে নিয়ে খাওয়াত আমাকে। অথবা আমিই ওকে খাওয়াতাম।

চাঁদ দেখে পবিত্র ঈদ উদ্‌যাপন শুরু হয়। তার মাহাত্ম্যের বর্ণনা গুণীজন দেবেন। বাঁশবাগানের মাথায় চাঁদ ওঠা দেখলে আমার অবশ্য সেই হারিয়ে যাওয়া কাজলাদিদির মুখটাই ভেসে উঠবে। তাকে মাটির নীচে দাফন করা হয়েছিল, নাকি পোড়ানো হয়েছিল চিতার আগুনে, সে তথ্যে আমার প্রয়োজন নেই।

ঈদ-উল-ফিতর, ৯ অগাস্ট, ২০১৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন