দোষ নেবেন না মাননীয়া ও মাননীয়েরা। কোনো এক হেমন্ত দ্বিপ্রহরে কিঞ্চিৎ
অধিকমাত্রায় সুরারস আস্বাদনের ফল এই আবোল-তাবোল বকবকানি আমার। কি সব যে লেখা
হযবরল ! কোনো মানে হয়?
ভর দুক্কুরে হুইস্কি-সোডা আর মুরগি-মটন? না গো সাহেব। এই দিশি সুরায়
যা রস তার তুলনা তোমাদের বিলিতি ম্যায়খানায় নেই গা। সুকুমার রায়
রচনা সমগ্র (সু-রা-র-স)
একবার মাথায় চড়াও হলে মাতাল হতে কোহল সন্ধান করতে হয় না।
“হযবরল” আর “আবোল-তাবোল” প্রায় সমার্থক হিসেবে ব্যাবহার করি আমরা,
অর্থহীন তালগোল পাকানো কাণ্ডকারখানা বোঝাতে। সুকুমারের রচনা
যে আপাত আজগুবি হলেও নিহিতার্থে অর্থহীন নয় সে কথা এখন বিদ্বজ্জনগণ স্বীকার করেন। হাস্যরসের আপাত-নিরীহ অর্থহীনতার নীচে
বয়ে যাওয়া ফল্গুটি গঙ্গা-যমুনার নিরমল পানির মতো সুশীতলা নয়। নিতান্ত আমিষ, রাজনৈতিক এবং ক্ষেত্রবিশেষে
কষ্টকর কস্টিক। বিনয় মজুমদারের কবিতা থেকে ভাব চুরি করে শব্দ বদলে বলা যায় “দৃশ্যত সরল,
কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে বক্র” সুকুমার সাহিত্য। এই দ্বিচারিতাই
যেকোনো দ্বিচারীর মতো সুকুমারের গতায়াত অবাধ করেছে রাজা আর প্রজা, ছানা আর বুড়ো,
কচি আর অতিপাকাদের সকল মুলুকে। বস্তুত এই দ্বিচারিতা
সূক্ষ্মতম সবকিছুর ধর্ম। সূক্ষ্ম মগজাস্ত্র বা সূক্ষ্মতম পদার্থ … ফেলু মিত্তিরের বাপের বাপ বা কোয়ান্টাম কণা…
উভয়েরই।
না, রাজনৈতিক সুকুমারকে
নিয়ে আমার নতুন কিছু বলার নেই। সে বিষয়ে অনেক কথা বয়ে গেছে দামোদর
নদী বেয়ে রাণাঘাট হয়ে তিব্বতের দিকে। আমি বলছি দ্বিচারী সুকুমার, তাঁর পোষা বেড়াল
যার দুই খোকা বড় হয়েছিল শ্রয়ডিঙ্গার আর কামুর বাড়িতে, সেই বেড়ালের আজগুবি ঘড়ি আর
ত্রিকালজ্ঞ কাকচক্ষু কাকেশ্বর কাকাবাবুর পেন্সিলের কথা। এককথায় খিচুড়ি কিম্বা
হযবরল।
এই নামটা আমাকে খুব ভোগাচ্ছিল... “হযবরল”। কেন এই নাম? কেন এই পাঁচটা বর্ণ?
শুধুই কি যাহা তাহা আবোল-তাবোল পাঁচফোড়নের পাঁচালি? হবেও বা! ক্ষ্যাপা লোক ইঁটের
পাঁজায় বসে বাদামভাজা খেতে খেতে না গিলে না ফেলে যা মনে এসেছে নাম দিয়েছে। দিক না।
তারপর একদিন পাশের বাড়ির শ্রীধরবাবুর কালিপুজোয় “কং নমো, খং নমো, গং নমো, ঘং নমো”
করে পুরুতের মন্ত্রপাঠ শুনতে শুনতে আর হাসি চাপতে চাপতে হঠাৎ হং নমোয় গিয়ে থোড়া
হঠকে এক হট অনুভূতি হল। ইস্কুল কলেজে ধম্মকম্ম আর ধার্মিকদের নিয়ে চিরকাল দেদার
খিল্লি করার ফলে এই কথাটা আগে কখনো জানা হয়নি যে মন্ত্রপাঠের আগে প্রতিটা বর্ণকে
এভাবে নমস্কার জানাতে হয়। সে যাক। কিন্তু হযবরল কেন? কেন নয় টঠডঢণ? সুকুমার আমাকে
এবার বিস্তর ছোটালেন যোগ-সাঙ্খ্য-ফিজিক্সের পথে। কোনোটাই শিখতে পারিনি। কিন্তু
সুকুমার না থাকলে এ মধ্যে একমাত্র ফিজিক্স ছাড়া কোনোটাই আদৌ পড়া হত না।
গপ্পোটাকে ছোটো করে বলি নামের সুলুক সন্ধান পাওয়া গেল কুণ্ডলিনি যোগে। এই
পাঁচটা বর্ণ বা অক্ষর হল নিচের দিকের পাঁচটি চক্রের বীজমন্ত্র... অবরোহে এবং
বর্ণবিপর্যয় সমেত। একদম মেরুদন্ডের মূল থেকে শুরু করে কন্ঠ অবধি পাঁচটা চক্র মূলাধার,
স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ-র বীজ অনুস্বারাক্রান্ত (দ্বিতীয়ার্থে) ল, ব,
র, য, হ। নদী যেমন স্বভবতই উত্তরমুখী, অর্থাৎ প্রশ্ন থেকে উত্তরের দিকে বা
মেদিনীপুর থেকে তিব্বতের দিকে যায় অজয়-দামোদর-পদ্মা-মিসিসিপির মতো; জ্ঞান-গঙ্গা
তেমনি দক্ষিণা তথা নিম্নগামী। সুকুমারের মতো হিজিবিজবিজ মানুষ স্বভাবতই সাধনার সিঁড়ি
উপর থেকে নীচের দিকে চড়েন। বিশুদ্ধ থেকে মূলাধার... ব্যাক টু আড়াই প্যাঁচ জিলিপি
সাপের যোগনিদ্রা। আজ্ঞা চক্র ওং-এ ওঠার কোনো দায় নেই। মর্তে থাকি। দেহে থাকি। সগগে
যাবার তাড়া নেই কো। বয়েস যেই চল্লিশ হবে চাকা ঘুরিয়ে নেমে আসবো কন্ঠ থেকে
মূলাধারে। যোগ বলে ষটচক্র ভেদ করতে সময় লাগে ন্যূনতম পঁইয়তাল্লিশ বছর। অত সময় ছিল
না সুকুমারের। সময়ের দখল কোনো বিধিগত সাধনার হাতে ছেড়ে দেবার স্পৃহাও ছিল না।
সুকুমার তাই সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে থাকলেন। এমন সময় আপনি যদি তাঁকে দেখেন কোনো এক
খুন্ড মুহুর্তে... ধরা যাক বক্ষে (অনাহত চক্রে)... বুঝতেই পারবেন না তিনি উঠছেন না
নামছেন, যতক্ষণ না তাঁকে শুধোচ্ছেন , “বাড়তি না কমতি”? হাইজেনবার্গের আনসারটেইনটি
প্রিন্সিপল বলে সুকুমার ঠিক কোন চক্রে আছেন এবং কোন দিকে যাচ্ছেন, সে দুটো ব্যাপার
একসাথে সঠিক বলা সম্ভব না। যাকে বলে ইলেকট্রনের গেছো দাদা চরিত্রম। সুকুমার
হাইজেনবার্গ অধ্যয়ন করেছিলেন এমন কথা বললে রামছাগলে গুঁতিয়ে দেবে। এই অসামান্য
ভাবনা একান্তই তাঁর, যার বালি-পাথর যুগিয়েছিল সম্ভবত সাঙ্খ্যদর্শন। সাংখ্যের
অভীষ্টে পৌঁছানোর প্রায়োগিক পদ্ধতি পাতঞ্জলির যোগ, আর যোগের তান্ত্রিক রূপ
কুণ্ডলিনী যোগ।
স্থান আর সময়ের ওপর সম্পূর্ণ দখলদারী যেহেতু চাই সুকুমারের, তাই তিনি ব আর
র-এর অবস্থান দিলেন এদিক ওদিক করে। দুই নম্বর সুকুমারী খেল। যাতে বাক্স খোলার আগের
মুহূর্ত অব্দি বলা না যায় বেড়ালটা জীবিত না মৃত... চশমালংকৃত না রুমালিভূত। হযবরল
জুড়েই তিনি এই কাণ্ড করেছেন। অজ্ঞেয়তা, প্রত্যাশার ধ্বস-জনিত অস্বস্তি আর হাসির এক অনাস্বাদিতপূর্ব চানাচুর।
এই কিম্ভূত রচনায়
সুকুমার রায় সময় (কাল) আর স্থান (দেশ)-কে নিয়ে এমনভাবে খেলা করেছেন যে সুকুমারী
সময়কে স্থানের প্রেক্ষিত ছাড়া ভাবা যায় না, তাঁর দেশকে ছোঁয়া যায় না কালের হাত ধার
না করে। দেশকাল যেন একটা যৌগ সত্তা হয়ে ওঠে। স্থানের প্রেক্ষিতে কালের এরকম সংজ্ঞা
ততদিনে মাত্র দুজন ভেবছিলেন। কপিল নামে পরিচিত সাংখ্যকার এক অনার্য প্রাক-বৈদিক
দার্শনিক, আর আইনস্টাইন নামে এক খ্যাপাটে ইহুদি বেহালাবাদক যিনি মাঝে মাঝে অঙ্ক
করতেন আর প্রশ্ন করতেন “সাত দুগুনে কত হয়?” হাতে পেন্সিল নিয়ে চোদ্দর চার নামানোর
সঠিক মুহূর্তের অপেক্ষায় এক ক্ষ্যাপা বিজ্ঞানী আর মুহূর্তকে ক্ষুদ্রতম কণার
ক্ষুদ্রতম দূরত্ব অতিক্রম করার জন্য প্রয়োজনীয় কাল হিসেবে চিহ্নীত করা এক নির্জন
ভাবুক... তাঁদের মাঝখানে গড়াগড়ি দিয়ে
হাসছেন হিজিবিজবিজ।
৩০ অক্টবর ২০১৪
৩০ অক্টবর ২০১৪
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন