শুক্রবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৬

রাষ্ট্রায়ত্ত ৪৭টা লাশ ~ অবিন দত্তগুপ্ত

যখন এ লেখা লিখছি , তখন রাষ্ট্রায়ত্ত লাশের সংখ্যা ৪৭ । ৫০০-১০০০ এর দেশপ্রেমিক অন্তর্ধান-এর জন্য আপাতত মারা গেছেন ৪৭ জন মানুষ । ৪৭ জন মানুষ ,যাদের বিভিন্ন নাম - বিভিন্ন ভাষা - বিভিন্ন ধর্ম - বিভিন্ন জাত । ৪৭ জন মানুষ ,যাদের প্রত্যেকের শ্রেণী এক । তারা নিম্নবিত্ত , হ্যাভ নট্‌স । এ লেখার কোন অর্থনৈতিক ধার ও ভার নেই । এ লেখা শুধুই ওই ৪৭-এর শ্রেণীকে কুর্নিশ জানানো একটা প্রিভিলেজ্‌ড্‌ হিজিবিজি । এ লেখা ৪৭-এর শ্রেণীর প্রতি হাল্কা অভিমান নিয়ে বলা কয়েকটা কথা মাত্র । সংখ্যা অদ্ভুত । ৪৭ । মুক্তি-পরাধীনতা-আশা-আশাভঙ্গের সঙ্খ্যা । 
যেদিন প্রথম ৫০০-১০০০ বন্ধের নির্দেশ এলো , তার পরেরদিন-ই আমি বাজারের দিকে গেছিলাম । আমার পরিচিত এক ফুল-আলি আছেন বাঘাযতীন বাজারে , তার সাথেই কথা হচ্ছিল । টাকা নিয়ে চুড়ান্ত কনফিউশনে ,ওনার সেদিন একটাও মালা বিক্রি হয় নি । রাতে কি খাবেন , কাল কি করে ফুল কিনবেন , কিনলেও বিক্রী হবে কিনা জানেন না । উনি আমায় বলেছিলেন , "মাত্র এক দুদিনের কষ্ট । যা হচ্ছে, আমাদের জন্যই তো হচ্ছে । দুদিন পরে সব ঠিক হয়ে যাবে , সবাই বলছে । তার পর জিনিসপত্রের দাম কমে যাবে , বড়লোকের টাকা কমবে , আমরা ভালো ভাবে বাঁচতে পারবো । মাত্র দুদিন , আমার ছেলেটাও আজ জন খাটতে পারলুনি দাদা , তাতে কি ! মা-ব্যাটায় আধ পেটা খেয়ে দুদিন ঠিক টেনে দেবো । এমন তো কতো দিন-ই গেছে । তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে । "
আজ নিয়ে প্রায় তিনদিন হয়ে গেলো , উনি আর বাজারে বসছেন না । ৪৭ এর আশা । ৪৭ এর আশাভঙ্গ । 
এর পর পর থেকেই বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে বিভিন্ন খবর পেতে থাকি । ডায়মন্ডহারবারের কাছে মাছ-এর পাইকারি বিক্রীর একটি বিশাল বাজার আছে । ট্রলার গুলো মাছ ধরে সরাসরি এখানে নিয়ে আসে ,এবং এখান থেকেই ছোট বা খুচরো ব্যবসায়ীরা সেই মাছ কিনে নেন । ওই বিশাল বাজারটা গতকাল বন্ধ হয়ে গেছে । কেন ? প্রশ্নের উত্তর পেলাম ,আমারি এক মালায়ালি বন্ধুর কাছে । সমুদ্রের পারে বাড়ি তার । জানাচ্ছে তার অভিজ্ঞতাও আমার-ই মতো । জেলেরা যে মাছ ধরে আনে ,সেটা কেনার মতো ক্যাশ টাকা খুচরো বিক্রেতাদের বা পাইকারি বিক্রেতাদের নেই । তাই বেশীর ভাগ মাছ পচে যাচ্ছে । এ সম্পর্কে প্রথম যখন সে খবর সংগ্রহ করতে গিয়েছিল ,তখন কেরালার জেলেদের বক্তব্য-ও ,বাঘাযতীনের ফুল-ওয়ালি দিদার মতো ছিল । তারাও ভেবেছিলেন , এক দিন দু দিনের ব্যাপার । দেশের জন্য এটূকু তারা করতেই পারেন । গত আটদিনে কজন জেলে আত্মহত্যা করেছেন, এ খবর জানা নেই । 
একই অভিজ্ঞতা আপনাদের সকলের হয়েছে । ক্ষেতে কাজ করতে যাওয়া ভাগ চাষি থেকে সেলুনে রোজের হিসেবে কাজ করা নাপিত , তারা প্রত্যেকে নিজেদের ভাগের অনেকটা ছেড়ে দিতে চেয়েছে স্বেচ্ছায় ,অনেক কষ্ট সহ্য করে ,আধপেটা খেয়ে । তারা এটা করেছে ,কারণ তাদের শ্রেণী চরিত্র তাদের বিশ্বাস করতে শিখিয়েছে । তাদের কাছে দ্যাশ কোন ভুখন্ড নয় । দেশ মানে তাদের মতোই মানুষ । ৪৭এর একান্নবর্তী পরিবার । তারা বিশ্বাস করতে চেয়েছে ,এবার অন্তত তাদের দেশকে তারাই নিয়ন্ত্রন করবে । বিশ্বাস করতে চেয়েছে ,বড়লোকের অনৈতিক ঐশ্বর্যের থেকে তাদের প্রাপ্য ভাগ এবার তাদের কপালে জুটবে । তাই তারা সহ্য করেছে । এই কোটি কোটি সাধারণ নামহীন মানুষের অনন্ত সহ্যশক্তির নাম ভারতবর্ষ । মা যেমন নতুন সন্তানের জন্মের সময় ব্যথা সহ্য করে , এরাও তেমন সহ্য করেছে । কিন্তু প্রতিবার মৃত-বিকৃত মাংসের দলা ছাড়া কিছুই প্রসব করতে পারে নি । মুক্তির যন্ত্রণা সহ্য করেছে , বদলে ইনাম জুটেছে আরও বেশী বন্দিত্ব । 
এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো । কিন্তু ৪৭-এর শ্রেণী চরিত্র শুধুই সহ্যের গল্পকথা নয় । ঘৃণাও তার একটি মুল বৈশিষ্ট বৈকি । বড়লোকদের প্রতি ,তাদের অন্যায় ভাবে অর্জিত সম্পদের প্রতি ঘৃণা । যারা তাদের মানুষের মতো বাঁচতে দেয় না , তাদের বৈভবের প্রতি ঘৃণা । যারা তাদের ভুল বুঝিয়েছে - মিথ্যে বলেছে - সেই দালালদের প্রতি ঘৃণা । শ্রেণী ঘৃণা । যে সময় মজুরি না পেয়ে ৪৭ ধুকছে ,আস্তে আস্তে কবর আর চিতার দিকে এগোচ্ছে - সে সময় তারা খবর পেলো এক দালালের মেয়ের বিয়ে হয়েছে পাঁচশো কোটি টাকা খরচ করে । তারা খবর পেলো , দু তিন দিন ভুয়া কথা - কদ্দিন লাগবে কেউ ঠিকঠাক জানে না । তাদের কুর্বানির বিনিময় জিনিসপত্রের দাম যখন কমলো না , তাদের কষ্টার্জিত সেভিংসে যখন ইন্টারেস্ট রেট কমতে আরম্ভ করলো ... ৪৭ জন মারা যাবার পর যখন তাদেরি মতো ৪৭ কোটি দেখতে পেলো একটাও বড়লোকের একটা চুলেও কোন আঁচর পরেনি , তখন তারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে । ফুটপাথের উপর ভারী হাতে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায় । তারা ভীরু - তারাই বীর । এরপর তারা ধ্বংশ করে । তারপর তারাই সৃষ্টি করে । আকাশের পাখির মতো - সমুদ্রের মাছের মতো তারা অগণিত । 
আমি আজ আবার বাজার গিয়েছিলাম । পাড়ার সেলুনে ,মুচির দোকানে । আমাদের পাড়ায় যে ছেলেটা একশো দিনের কাজ করে তার সাথেও কথা হয়েছে । একটা নিঃশব্দ ঘৃণা । প্রতারিত হওয়ার যন্ত্রণা তাদের চোখে । মধ্যপ্রদেশে কারা যেন রাগে ফেটে পড়েছে । কেরালা - তামিলনাডুতে আগুন জ্বলছে । প্রতারিত ৪৭-রা , প্রত্যেকটি লাশের হিসেব বুঝতে চাইছে । আর জানলায় নয় । রাস্তায় আগুন লক্‌ লক্‌ করে জ্বলছে ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন