শনিবার, ২৮ জানুয়ারী, ২০১৭

বৈষম্য ~ সুশোভন পাত্র

​গত বছর, পিকনিকে গিয়েছিলাম দশজনে। সকালে বেগুনী মুড়ি। দুপুরে সরু চালের ভাত, মুগের ডাল, খাসি মাংস আর রসগোল্লা। সব মিলিয়ে, মাথাপিছু ৩০০ টাকা। নিজেরাই রাঁধলাম। নিজেরাই খেলাম। ফিরতি পথে 'বাজারে' সব দোকানের ধার মেটালাম। ছিল ৩,০০০। খরচা হল ৩,০০০। নো লস। নো গেন।
এবারও গিয়েছিলাম। একই জায়গা, একই মেনু, একই দশই। এবার 'বাজার' থেকে চাল-ডালের সাথে 'পণ্য' হিসেবে ১২০০ টাকায় কানাই রাঁধুনির 'শ্রমটাও কিনলাম'। শেষ বেলাতে জুটল আরও দুই হাফপ্যান্টের বন্ধু। মাথাপিছু ৪২০ করে ৫,০৪০ টাকা 'পুঁজি' হিসেবে আগেই জমা রাখলাম। আমি তখন 'পুঁজিপতি'। আমার তখন পকেট গরম। কানাই কে বললাম "১,২০০'তেই দশ নয় বারো জনের রান্না করতে হবে। না পারলে বল, গোপাল রাজি আছে।" নোয়াপাড়ার গোপাল আজকাল 'বেকার রাঁধুনি'। 'নাই মামা'র থেকে কানা মামা ভালো' ফর্মুলায় কানাই রাজি হল। এবার আমরা আড্ডা মারলাম, তাস খেললাম, আর কানাই কে দিয়ে রান্না 'করালাম'। প্রথম দশজনের রান্না কানাই'র 'আবশ্যিক শ্রম'। আর বাকি দুজনের রান্না কানাই'র 'উদ্বৃত্ত শ্রম'। জমিয়ে খেয়ে, কানাই কে ১,২০০ দিয়ে, 'বাজারে'র ৩,৬০০ মিটিয়ে যখন বাড়ি ফিরলাম; পকেটে তখনও ২৪০ টাকা পড়ে। এই ২৪০, 'উদ্বৃত্ত মূল্য'। এই ২৪০ আমার 'প্রফিট'। এই ২৪০ দিয়ে আমি গোল্ডফেল্ক কিংস'র আস্ত একটা প্যাকেট কিনলাম। আর রাতে কানাই'র 'প্রাপ্য মূল্যে' আমার 'ব্যক্তিগত সম্পত্তি' ঐ গোল্ডফেল্ক কিংস' ফুঁকে ওড়ালাম।
শ'খানেক বছর আগে ছুঁচলো দাড়ির টেকো লোকটা মস্কো তে বসে যখন লিখছিলেন "বিকাশের যে স্তরে শ্রমশক্তি নিজেই পণ্য তাকে বলে পুঁজিবাদ"¹ ; তখনও কানাই রান্নাই শেখেনি। তারও পঞ্চাশ বছর আগে গাল ভর্তি দাড়ি আর মাথা ভর্তি চুল নিয়ে আরেক ভদ্রলোক যখন ব্রাসেলস বসে লিখছিলেন "শ্রমই সকল সম্পত্তির উৎস। এই শ্রমের শোষণেই পুঁজিবাদে সম্পত্তির বিপুল কেন্দ্রীভবন এবং বৈষম্য অবশ্যম্ভাবী" ² ; তখনও গোল্ডফেল্ক কিংস বাজারেই আসেনি। তখনও গ্রেট ব্রিটেনের ১৭-ব্রডস্ট্রিটে অক্সফামের অফিস গজায়নি ³ । সেই অক্সফাম যারা প্রতিবছর নিয়ম করে 'পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান আর্থিক বৈষম্য' নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক করে। 'গরীব হটাও' যজ্ঞের রিপোর্ট লেখে। রাষ্ট্রপ্রধান'দের অসম্ভব বৈষম্যের ভয়ঙ্কর পরিণতি সম্পর্কে সাবধান করে। ২০১৬'তে অক্সফাম লিখেছিল "বিশ্বের প্রথম ৬২ জন ধনী ব্যক্তির মোট সম্পদ বিশ্বের অর্ধেক জনসংখ্যার সম্মিলিত সম্পদের সমান" ⁴ । আর ২০১৭'তে 'ইকনমি ফর ১%' রিপোর্টে বলেছে "বিশ্বের প্রথম ৮ জন ধনী ব্যক্তির মোট সম্পদ বিশ্বের অর্ধেক জনসংখ্যার সম্মিলিত সম্পদের সমান " ⁵।
এদেশে সংখ্যাটা ৫৭। মাত্র ঐ ৫৭ জন ধনকুবেরর মোট সম্পদ এদেশের গরীবতম ৭০% মানুষের সম্মিলিত সম্পদের সমান। আর মাত্র ১% ধনী অংশের পকেটে এদেশের ৫৮% সম্পদ। ৯১'র আর্থিক সংস্কারে যেদিন দেশের 'হটডগ' বাজার পৃথিবীর জন্য মুক্ত হল, করতালি তে মুখরিত হয়েছিলো লন্ডন থেকে লোনাভেলা, কেন্ট থেকে ক্যাওড়াতলা। আর আজ দেশ জোড়া উন্নয়নের চোটে গত ২৫ বছরের প্রতি বছরে, দেশের গরীবতম ১০%'র আয় যেখানে বেড়েছে গড়ে ২,০০০, সেখানে দেশের ধনীতম ১০%'র আয় বেড়েছে গড়ে ৪০,০০০ ⁶। গত ১৫ বছরে দেশে যে ১৪৪ ট্রিলিয়ন নতুন সম্পত্তি তৈরি হয়েছে তার ১১১.৩ ট্রিলিয়নই ঐ প্রথম ১০%'র উদরস্থ হয়েছে। আর বাকি ৩২.৭ ট্রিলিয়ন জুটেছে বাকি ৯০%'র কপালে। "ট্রিকল ডাউন পলিসি"র দয়ায় ৯১'এ বিশ্বের এক-পঞ্চমাংশ ক্ষুধার্তের ঠিকানা ছিল যেখানে ভারত, এখন তা বেড়ে এক-চতুর্থাংশ। ৯১'এ বিশ্বের মোট নিরক্ষরতার ৩২.৬% ঠিকানা যেখানে ছিল ভারত, ২০১৪ তে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫.৬৫% ⁷ ⁸।
অক্সফাম বলেছে, ভারতের ব্যাপক আর্থিক বৈষম্যের মূলে সর্বস্তরের শ্রমিকের প্রাপ্য মজুরির বঞ্চনা। অক্সফাম জানে না, সারাবিশ্বে দৈনিক দুই ডলারের কম রোজগার করা শ্রমিকের সংখ্যা যেখানে গড়ে ২৮%, আমাদের দেশে ৫৯% ⁹। অক্সফাম বলেছে, সমাধানের পথ শিক্ষা ,স্বাস্থ্যে সরকারী বিনিয়োগ বৃদ্ধি। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি। অক্সফাম জানে না, গত বছর বাজেটে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাখাতে ১৩,৬৯৭ কোটি এবং উচ্চশিক্ষা খাতে ৩,৯০০ কোটি সরকারী বরাদ্দ হ্রাস করা হয়েছে ¹⁰। ১৫%'র ছাড়া বাকিদের জন্য ফেলোশিপ 'ডিসকন্টিনিউ'র সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ¹¹। অক্সফাম জানে না, ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভের রিপোর্টে এদেশের ৭৮% স্বাস্থ্য ব্যবস্থারই আজ বেসরকারিকরণ হয়েছে ⁸। অক্সফাম জানে না, লেবার ব্যুরোর রিপোর্টে গত বছর এদেশে রেকর্ড হারে বেকারত্ব বেড়েছে ¹² । অক্সফাম বলেছে, রাজনৈতিক প্রভাব ও কর ফাঁকির সিঁড়ি বেয়েই এদেশের ধনকুবের'দের রমরমা। অক্সফাম জানে না ; এদেশ ললিত মোদীর। এদেশ বিজয় মালিয়ার। এদেশের সরকার মুকেশ আম্বানির। এদেশের আইন গৌতম আদানির। এদেশের হাইকোর্ট সলমন খানের। এদেশের 'কর্পোরেট পলিসি' হাজার-কোটির ট্যাক্স ছাড়ের।
স্তালিনের নাম শুনলেই তেলে-বেগুনে জ্বলে আপনি উঠতেই পারেন, সোভিয়েতের প্রশংসায় 'অ্যানিম্যাল ফার্মের' অর্গাজমে স্বর্গসুখ আপনি পেতেই পারেন, বলিভিয়ার নিবিড় অরণ্যে ঐ দাড়িওয়ালা গ্ল্যামারাস ডাক্তার ছেলেটার মৃত্যুর প্রতি নিরাসক্ত আপনি থাকতেই পারেন, তীব্র শৈত্য প্রবাহে রেড আর্মির লং-মার্চ কিংবা পাভেল করচাগিনের ইস্পাত কঠিন লড়াই কে ব্যঙ্গ আপনি করতেই পারেন, এমনকি ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিনের দাড়ির থেকে রামদেবের দাড়িই আপনার বেশি পছন্দ হতেই পারে; কিন্তু গীতার 'শ্লোক' থেকে কোরানের 'সূরা' হয়ে বাইবেলের টেস্টামেন্ট -কোথাও এই ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের অর্থনীতির বিশল্যকরণী আপনি খুঁজে পাবেন না। পুঁজিবাদী বাজারে হিন্দু-মুসলমানের ক্যালোরির আলাদা হিসাব কষতে আপনি পারবেন না। মুক্তবাজারের মুনাফা তে ব্রাহ্মণ-দলিত'র 'উদ্বৃত্ত শ্রমের' পার্থক্য আপনি করতে পারবেন না। ধর্মের বুলি কপচে দু'বেলা দু'মুঠো ভাতও আপনি জুটিয়ে দিতে পারবেন না। কারণ বাস্তব এটাই যে আপনার-আমার শ্রম যে আজ 'বাজারের পণ্য'। বাস্তব এটাই যে শ্রমের শোষণেই পৃথিবী জোড়া সম্পদের এই যে প্রবল বৈষম্য। আর বাস্তব এটাই যে ধর্মশাস্ত্র বা অ্যাডাম স্মিথের 'দি ওয়েলথ অফ দি নেশন'র পুঁজিবাদী মুক্ত বাজারে নয়; দাড়ি বুড়োর 'দাস ক্যাপিটাল'ই বন্দী আছে অর্থনীতির সাম্য।

1. https://www.marxists.org/archive/lenin/works/1916/imp-hsc/

2. https://www.marxists.org/archive/marx/works/subject/quotes/


3. https://en.wikipedia.org/wiki/Oxfam

4. https://www.oxfam.org/.../bp210-economy-one-percent-tax...

5. https://www.oxfam.org/.../bp-economy-for-99-percent...

6. https://scroll.in/.../embargoed-jan-16-00-01gmt-57...

7. https://www.youtube.com/watch?v=Wtzs4lygpA0

8. http://timesofindia.indiatimes.com/.../artic.../54822103.cms

9. http://www.reuters.com/article/idUSDEL218894

10. https://cpim.org/.../do-saal-janta-behaal-modi-government...

11. https://www.youtube.com/watch?v=lpUrKAomkqU

12. http://indianexpress.com/.../unemployment-india-paints.../

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন