শুক্রবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৭

হাসপাতালের জার্নাল ~ অরুণাচল দত্ত চৌধুরী

যাহা বলিব সত্য বলিব 
অথবা 
কার্নিভ্যাল সমগ্রঃ

গত ৬ই অক্টোবর আমার অ্যাডমিশন ডে ছিল।  সরকারি জেলা হাসপাতালে। ওয়ার্ডের নোটিসবোর্ডে আমার নাম Dr.A.D.C.
সকাল ৯টা থেকে পরের দিন সকাল ৯টা অবধি যত রোগী/রোগিনী ভর্তি হবেন সব টিকিটে লেখা আমার নাম। অর্থাৎ এই রোগীদের ভর্তি পরবর্তী চিকিৎসা,  রেফারেল, যদি মৃত্যু ঘটে সে'ই দুঃখজনক ঘটনা সব কিছুর জন্যই "আই উইল বি হেল্ড রেসপন্সিবল।"
এই ২৪ ঘণ্টা কাটানোর পর সব মিলিয়ে আমার অবস্থা কেমন? শরীরের কথা থাক। মনের কথাটা বলি। উদাহরণ দিয়ে বলি। কিশোর বেলায় ঘুড়ি ওড়ানোর সময় ঘুড়ি যখন আকাশে আর লাটাই আমার হাতে সেই সময় উত্তেজিত থাকতাম খুব। কখন সুতো ছাড়ব, কখন টানব, ঘুড়ি কোন বাতাসে কোন দিকে গোঁত্তা খাচ্ছে … সে এক তুলকালাম অবস্থা। কিন্তু সেই ঘুড়িটা কেটে গেলে, মন নিমেষে উত্তেজনা মুক্ত। কাটা ঘুড়ির পেছনে দৌড়োনো স্রেফ অভ্যেস বশে। মন জানে, লাভ নেই। এখনও প্রায় সেই রকমই। ভর্তি রোগীর সংখ্যা অকল্পনীয় হওয়ায়, মনে আর কোনও চাপ নেই। অপরাধবোধ? তা' একটু রয়েছে বটে। আশা, প্রশাসকদের দেখে সেই লজ্জা আবরণটিও সরে যাবে।
যখন আমার নামে ভর্তি হওয়া মানুষের মোট সংখ্যা পঞ্চাশ ষাট ছিল কয়েকসপ্তাহ আগেও জানতাম ঘুড়িটা উড়ছে। কান্নিক খাচ্ছিল… তবুও উড়ছিল। কিন্তু তার পরে এই জেলায় পাল্লা দিয়ে বেড়েছে জ্বর, সেই কারণে প্রচুর মৃত্যু, আর অকল্পনীয় মৃত্যুভয়।
অথবা অন্য ভাবে বললে, ভর্তি রোগীর সংখ্যাটা যতদিন কম ছিল মানে কম বেশি একশ', জানতাম যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে কাজ করছি। আজ যখন সে সংখ্যা পাঁচশ'র আশেপাশে, জেনে গেছি যুদ্ধ অসম্ভব। বন্যার জল ঢুকে পড়েছে, এখন একমাত্র গতি ভেসে যাওয়া।
ইতিমধ্যে কর্পোরেট হাসপাতালে জ্বরে মৃত্যুর কারণে ভাঙচুর মহামান্য মিডিয়া সাড়ম্বরে ছেপেছে। দেখিয়েছে।
সেই মিডিয়া কিন্তু প্রান্তিক হাসপাতাল দেগঙ্গা বা রুদ্রপুর হাসপাতাল ছেড়ে দিন, এমন কী জেলা হাসপাতালে উঁকি দিয়েও দেখেনি। কাজ সেরেছে সম্ভবত স্থানীয় স্বাস্থ্য প্রশাসকদের সাথে কথা বলে, যাদের একমাত্র কাজই হচ্ছে তথ্য চেপে যাওয়া।
যাই হোক, যা বলছিলাম, মেডিসিন ওয়ার্ডের মেঝে ছেড়ে উপচে ওঠা ভর্তি রোগীর ভিড় নেমে এসেছে হাসপাতাল বিল্ডিংএর অন্যান্য মেঝেতে, যেখানেই প্লাসটিক শিট পাতার সামান্যতম জায়গা রয়েছে, সে'খানে। 
পা রাখার জায়গা আক্ষরিক অর্থেই নেই। ভর্তি রোগীর মোট সংখ্যা? কেউ জানে না, শুধু কম্পিউটার জানে। 
সবার গায়ে জ্বর। অনেকের কাছেই বাইরের ল্যাবে করানো ব্লাড রিপোর্ট। সবারই এক আর্তি, রিপোর্টে ডেঙ্গু ধরা পড়েছে, অর্থাৎ এনএসওয়ান পজিটিভ আর প্লেট(পড়ুন প্লেটলেট) কমেছে। সবার বাড়ির লোকের দাবী, স্যালাইন দাও।

সবাইকে সেই দিনের ভারপ্রাপ্ত ডাক্তার ইচ্ছে থাকলেও ছুঁয়ে দেখতে পারছে না। কারণ ত্রিবিধ। প্রথমত মোট  রোগীর সংখ্যা, সম্ভবত পাঁচশ, একলা দেখতে হবে রাউন্ডে। দ্বিতীয়ত বেড হেডটিকিটের উল্লিখিত রোগীকে খুঁজে পাওয়া। কোন বারান্দার বা কোন ঘুপচির মধ্যে গাদাগাদি হয়ে রয়েছে সে হাজার ডাকাডাকি করেও পাওয়া যাচ্ছে না। তৃতীয়ত খুঁজে যদিও বা পাওয়া গেল, গায়ে গা লাগিয়ে শুয়ে থাকা মানুষগুলোর কাছে অন্যকে পায়ে না মাড়িয়ে পৌঁছোনো কার্যত অসম্ভব। 
জেলার স্বাস্থ্য প্রশাসক অতি চালাকের মত বিবৃতি দিচ্ছে হাসপাতালে সব ব্যবস্থা(পড়ুন নির্ভেজাল অব্যবস্থা) রয়েছে। হাসপাতালের প্রশাসক অসহায়। অলিখিত নির্দেশ রয়েছে অব্যবস্থার কথা বা ছবি ঢাকতে হবে যে কোনও মূল্যে। তা' নইলে নেমে আসবে ব্যক্তিগত কোপ। আর তার নিজেরও আনুগত্য দেখিয়ে স্বাস্থ্যভবনের প্রসাদকণা পাবার আকাঙ্ক্ষা বড় কম নয়। 
আর আমি? একদিনে যাকে দেখতে হবে কমবেশি পাঁচশ জন, সেই আমি অতিব্যস্ত আগামী এক দেড় দিনের মধ্যেই নমো নমো করে এ'দের অনেককে জ্বর গায়েই বাড়ি পাঠিয়ে দিতে, কেন না পরের দিন গুলোয় নতুন পাঁচশ জনের তো "সাব হিউম্যান তবু সব ব্যবস্থা থাকা" সরকারী হাসপাতালে জায়গা চাই। আক্রান্ত জনসমুদ্র ঝাঁপয়ে পড়ছে ইমারজেন্সিতে।
এর মধ্যেই মারা যাচ্ছে জ্বরের রোগী। বুঝিয়েসুজিয়ে(প্রশাসনিক জবানে কাউন্সেলিং করে), কান্না মোছানোর চেষ্টা করছি। ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারণ লিখছি…না না ডেঙ্গু নয়। 
এই রাজ্যে ডেঙ্গু হওয়া বারণ। এই অতি চালাক আমি… রক্তচোখের ভয়ে  ভীত কেন্নোর মত সন্ত্রস্ত এই আমি অভাগার ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারণ লিখছি 'ফিভার উইথ থ্রম্বোসাইটোপিনিয়া'।
আর রক্তচোখের মালকিন মালিকেরা তখন কার্নিভ্যালে কৃত্রিম একধরণের ঠোঁট প্রসারিত চালাক চালাক প্রায় অশ্লীল হাসির ভঙ্গিমায়, কখনও বিসর্জন দেখছে, কখনও দেখছে ফুটবলের কবন্ধ রাক্ষুসে মূর্তি। 

এর মধ্যে বলাই বাহুল্য জ্বর ছাড়া অন্যান্য রোগীরাও ভর্তি হয়েছেন মেডিসিন ওয়ার্ডে। মানে হার্ট অ্যাটাক, সেরিব্রাল স্ট্রোক, সিরোসিস, কাশি-বমিতে রক্তপাত, খিঁচুনি ইত্যাকার বহু দুর্ভাগা। তাঁদের দেওয়া সুচিকিৎসা(?)র কথা সহজেই অনুমেয়। আমার দেওয়া তথ্যের সমর্থনে রোগীদের দুর্দশার ছবি মোবাইলে তুলে সাঁটানোই যেত এই দেওয়ালে। কিন্তু মহামহিম স্থানীয় প্রশাসক কার যেন মোবাইল এই অপরাধে নাকি বাজেয়াপ্ত করেছেন। সরকারী গোপন তথ্য ফাঁস করা অপরাধ। 
একটা পুরোনো রাশিয়ান কৌতুকী মনে পড়ল।
শিক্ষামন্ত্রীকে গাধা বলেছিল একটা লোক। বিচারে দু'দফায় জরিমানা হয়েছিল তার। প্রথম কারণ শিক্ষামন্ত্রীকে অপমান, দ্বিতীয় কারণ রাষ্ট্রের গোপন তথ্য ফাঁস। 
জানি না আমার এই লেখায় সেই গোপন তথ্য ফাঁসের অপরাধ ঢুকে গেল কিনা।

প্রান্তিক ভোটার আপাতত জ্বরে কাঁপছে। কাঁপুক।
মরে যাচ্ছে। যাক।
অপ্রতিহত চলুক ভোগান্তি আর মৃত্যুর কার্নিভ্যাল।
নিষ্ঠুর হলেও সত্যি, আবার ভোট এলে প্রসাদ কুড়োনো করে কম্মে খাওয়া ভাইবেরাদরদের হাত দিয়ে পাঠানো হবে ভিক্ষের অনুদান। 
মশা আর ভোট বেড়ে যাবে এ'ভাবেই… ফিবছর।
-------------------------------------------------------------------
মেল মেডিসিন আর ফিমেল মেডিসিনের নোটিশ বোর্ডের ছবি দিলাম। বাহুল্যবোধে আইসোলেশন ওয়ার্ডেরটা দিলাম না।
---------------------------------------------------------

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন