মঙ্গলবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

সিরিয়া ~ আর্কাদি গাইদার


সিরিয়াতে মৃত এবং আহত শিশুর ছবি দেখে অনেকের টনক নড়েছে যে সিরিয়া বলে একটি দেশ আছে, এবং সেখানে কিছু একটা হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই, মানুষ যেটা করে অভ্যস্ত, মানে হলো পক্ষ বাছা, সেটাই করছে। এই পক্ষ বাছার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় যা হয়ে দাঁড়ায় তা হলো তথ্য। তাই মনে হয় সিরিয়ার এই ঘটনাবলী সমন্ধে কিছু তথ্য দিয়ে মানুষকে পক্ষ বাছবার কাজে সাহায্য করা উচিত।
১)সিরিয়ার যিনি শাসক, মানে আসাদ, তাকে পশ্চিমী দুনিয়া (অর্থাৎ আমেরিকা আর নেটো কোয়ালিশন) 'একনায়ক' হিসেবে প্রচার করে। যেমন সাদ্দাম, গদ্দাফি ইত্যাদি। আমেরিকা এবং নেটো চায় যে গদ্দাফি এবং সাদ্দামের মতন একটি 'গণঅভ্যুত্থান' এর মাধ্যমে আসাদকে সরাতে, যাতে তারা সেখানে 'গণতন্ত্র' এক্সপোর্ট করতে পারে এবং তেল, ব্যাবসা আর ভৌগলিক ঘাঁটির সুযোগ সুবিধে পেতে পারে। এর জন্যে অনেকদিন ধরেই নেটো এবং আমেরিকা আসাদকে আক্রমন করে আসছে।
২)আসাদের বিরোধীরা মূলত তিনরকম। এক, যারা গণতন্ত্রপ্রেমী। দুই, কুর্দরা। তিন, ইসলামিক মৌলবাদীরা।
৩)এর মধ্যে কুর্দদের ব্যাপারটা আলাদা করে বলতে হয়। কুর্দরা হলো মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় ভৌগলিক অঞ্চল জুড়ে বসবাস করা লোক। কিন্তু ব্রিটিশরা যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ওটোমান সাম্রাজ্যের ভাগবাটোয়ারা করছিলো, তখন উপনিবেশবাদের নিষ্ঠুর পরিহাসে কুর্দদের ভৌগলিক অঞ্চলটা পেনের দাগে ভাগ হয়ে যায় চারটে দেশের বর্ডারের মধ্যে - টার্কি, সিরিয়া, ইরাক, ইরান। অর্থাৎ এই চার দেশেই কুর্দরা সংখ্যালঘু হয়ে যায়। এর মধ্যে ইরানের সরকারের সাথে কুর্দদের সম্পর্ক ভালো, তাদের ক্যাবিনেটে কুর্দদের মন্ত্রীও রয়েছে। বাকি তিনটে দেশেই কুর্দরা বহুদিন ধরে আত্মনিয়ন্ত্রণের লড়াই লড়ছে। এবং টার্কি, ইরাকের সাদ্দাম, বা সিরিয়ার আসাদ - এদের সবার হাতেই কুর্দরা ঐতিহাসিকভাবে অত্যাচারিত। কুর্দদের একটি বিশাল অঞ্চল আছে যা তারা নিজেরা পরিচালনা করে। তাদের একটি সরকার, কাউন্সিল, প্রশাসন রয়েছে। তাদের বাহিনী রয়েছে। এই কুর্দ জাতীয়তাবাদী বাহিনী হলো পেশমার্গা। এই পেশমার্গাদের মধ্যে বড় অংশ হলো বামপন্থী এবং কমিউনিষ্টরা। রোহাভাতে একটি বিকল্প সমাজব্যাবস্থার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে কুর্দরা - ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক এক ব্যাবস্থা, মধ্যপ্রাচ্যের অন্ধকারের মধ্যে যা এক আলোর দ্বীপের মতন - যার নাম রোহাভা বিপ্লব।
৪)কুর্দদের পশ্চিমী দুনিয়া সন্ত্রাসবাদী মনে করে। টার্কির চাপে আমেরিকা, নেটো এবং আরও অনেকেই কুর্দদের 'সন্ত্রাসবাদী' সংগঠন হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। তার মধ্যেই কুর্দরা লড়ে চলেছে।
৫)সাদ্দাম বা আসাদ বা গাদ্দাফিরা ধর্মনিরপেক্ষ ছিলো এই নিয়ে সন্দেহ নেই। তারা গায়ের জোরে ধর্মীয় মৌলবাদীদের দমন করে রেখেছিলো। তেল এবং ক্ষমতার লোভে তাদের সরাতে আমেরিকা সামরিক অভিযানের সাথে সাথে মধ্যপ্রাচ্যে জুড়ে ধর্মীয় মৌলবাদীদের কে তোল্লাই দিয়েছে, অস্ত্র এবং অর্থসাহায্য করেছে, এবং গোটা অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। আজকে মধ্যপ্রাচ্যে যে ধর্মীয় মৌলবাদীদের এরকম দাপাদাপি, তার পেছনে অন্যতম কারন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী লোভ। আসাদকে সরাতেও নেটো ফ্রি সিরিয়ান আর্মি, আল নুসরা ফ্রন্ট জাতীয় গ্রুপকে তোল্লাই দিয়েছে, যারাই পরে গিয়ে আইসিস নামক রাক্ষসের জন্ম দিয়েছে। এটা মোটামুটি সেই সোভিয়েত তাড়াতে আফঘানিস্তানে তালিবানের সৃষ্টির গল্প।
৬) সাথে সাথে এটাও মনে রাখতে হবে যে আসাদ বা সাদ্দাম নিজ নিজ দেশে বামপন্থী, কমিউনিষ্টদের নিষ্ঠুর ভাবে দমন করেছে, খুন করেছে। ইরাক এবং সিরিয়ার কমিউনিষ্ট পার্টির ইতিহাস পড়লেই এই বিষয়ে ভালো করে জানা যাবে।
৭) সিরিয়াতে যে গৃহযুদ্ধ চলছে তার ৪টি প্রধান গোষ্ঠী রয়েছে। এক হলো আসাদের সরকারী বাহিনী। যাদের সমর্থন করে ইরান, হেজবোল্লা, রাশিয়া। দুই হলো ফ্রী সিরিয়ান আর্মি। এদের মধ্যে আসাদ বিরোধী বহু ছোটখাট দল রয়েছে। এদের প্রধান সমর্থক আমেরিকা আর নেটো। তিন হলো সিরিয়ান ডেমোক্রাটিক ফোর্স বা এসডিএফ। এদের মধ্যে প্রধান শক্তি কুর্দ পেশমার্গা, বামপন্থী এবং কমিউনিষ্টরা। এরা রোজাভা বিপ্লবের আদলে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক সিরিয়া গড়ে তুলতে চায়। আর চার হলো আইসিস। এই চারটি দলই বিভিন্ন সময় নিজেদের মধ্যে লড়াই করেছে। আবার একসাথে জোট বেধে অন্য দলের সাথে লড়েছে। এবং সেই রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং বাধ্যকতাকে মেনেই এদের সমর্থকরাও নিজেদের স্বার্থরক্ষার্থে অস্ত্র, অর্থ ইত্যাদি দিয়ে এই দলগুলোকে সাহায্য করেছে। যেমন ধরুন এসডিএফকে বিগত কয়েকদিনে আমেরিকা সাহায্য করেছে। যদিও তারা তার আগে ফ্রী সিরিয়ান আর্মিকে সাহায্য করতো। আবার আইসিসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময় অনেকক্ষেত্রে সিরিয়ান আর্মি আর এসডিএফ একসাথে লড়েছে, তখন তাদের সামরিক সাহায্য করেছে রাশিয়া। আবার আইসিস পিছু হটার পরেই যখন পেশমার্গাদের অবস্থান শক্তিশালী হচ্ছে দেখে নেটোর আরেক পার্টনার টার্কি কুর্দদের ঘাটিতে বোমা ফেলেছে তখন আমেরিকা কোন আওয়াজ করেনি।
৮) এই যুদ্ধে বিগত ৭ বছর ধরে শিশু এবং সিভিলিয়ানরা খুন হচ্ছে। আমেরিকা, নেটো, রাশিয়া, টার্কি, আসাদ বিভিন্ন লোক বিভিন্ন সময় তার জন্যে দায়ী। বিগত কয়েকদিনে যা ঘটেছে, তা হলো আল ঘৌটা নামক শহর, যা আপাতত মৌলবাদী বাহিনীর ঘাটি, সেই শহর দখল করতে আসাদের সিরিয়ান আর্মি বোমাবর্ষণ করছে নির্বিচারে। এবং তাতে যেই শিশু আর নাগরিকরা মারা যাচ্ছে, তার ছবি নিয়ে চারিদিকে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। প্রশ্ন হলো এর চেয়ে দশগুন শিশু এর আগে মারা গেলেও এরকম হাহাকার শোনা যায়েনি কেন? কারন হলো ওই ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট। সিরিয়াতে 'গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা' করতে নেটোর হানার আগে বিশ্বের সামনে আসাদের বিরুদ্ধে পয়েন্ট স্কোর করা সম্মতি নির্মাণ করা। আর রাশিয়ার আসাদকে সমর্থনের কারনও ওই আমেরিকাকে প্রতিহত করা আর আগামী নির্বাচনের আগে পুতিনের একটি সফল প্রজেক্ট রাশিয়ানদের সামনে আনা।
৯)তাহলে এবার আপনি পক্ষ বাছবার সময় ভাবতে বসবেন যে আপনি হাজার শিশুর খুনির পক্ষ নেবেন না দুশো শিশুর খুনির পক্ষ নেবেন? আপনি কি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বা স্বৈরাচার বা ধর্মীয় মৌলবাদের মধ্যে যেকোন একটা পক্ষ বেছে নেবেন? পক্ষ নিতে হলে তো একটাই পক্ষ আছে। সেটা হলো ওই নাগরিক, ওই শিশুদের পক্ষ। এই তেল, ব্যাবসা, ক্ষমতার বিপক্ষ। এই যুদ্ধের বিপক্ষ। পক্ষ নিতে হলে এসডিএফের পক্ষ নিন। রোহাভা বিপ্লবের পক্ষ নিন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন