বৃহস্পতিবার, ১৫ মার্চ, ২০১৮

কোশ্চেন এভরিথিং ~ কৃষানু মজুমদার

আমি একটা তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় শ্রম দিই। আমার বন্ধুতালিকার অনেকেই জানেন। যাঁরা জানেন না, এইটুকু পড়েই জেনে গেলেন। 
আমাদের কিছু জিনিস শেখানো হয়। মনে হয় সেগুলো অন্য শিল্পের কর্মীদেরও শেখানো হয়, তবে যেহেতু আমি সেসব শিল্পে কাজ করিনি, তাই সঠিক বলতে পারব না। 
উদাহরণ দিই। ধরা যাক তিনমাস ধরে খেটে খুটে বহু টাকা ও শ্রম খরচা করে একটা ওয়েবসাইট বানানো হল। তারপর সেই ওয়েবসাইট যখন ছাড়া হল (আমরা বলি প্রোডাকশন গো লাইভ) দেখা হল তাতে বেশ কিছু সমস্যা আছে, ছোট ও বড়। ছোট সমস্যাগুলোর আস্তে ধীরে সমাধান করা যায়। কিন্তু এমন কিছু বড় সমস্যা যদি থাকে, যার জন্য যে কাজের উদ্দেশ্যে ওয়েবসাইটটা বানানো হয়েছিল, সেটাই করা না যায়, তখন কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এই সময় প্রথমেই সন্দেহ দানা বাধে যারা কাজটা করেছিল, অর্থাৎ কোড লিখেছিল তাদের ওপর। কিন্তু আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে শিখেছি দোষ শুধু তাদের হতে পারে না, যারা জিনিসটার পরীক্ষা করে দেখে বলেছিল এর মান বা কোয়ালিটি নিয়ে সমস্যা নেই, তাদের-ও। কিন্তু শুধু তাদেরও নয়। হয়ত দেখা যাবে কী উদ্দেশ্য নিয়ে সাইটটি বানানো হচ্ছে সেটাও স্পষ্ট করে বোঝানো হয়নি। এইভাবেই ঠেকে শিখতে শিখতে বোঝা যায়, যে দোষ একজন ব্যক্তির হতে পারে না। নিশ্চই প্রসেসে কোথাও সমস্যা ছিল। তাই গুরুত্ব দেওয়া শুরু হয় ব্যক্তিকে নয়। প্রসেসকে। Process over people। 
পরেরবার এইধরণের কাজের জন্য এটা একটা শিক্ষা হিসেবে কাজ করে। তাই এইধরণের ব্যর্থতার থেকে আমরা শিখি কী ভুল হয়েছিল। এটা কোনো নির্দিষ্ট সমস্যার ক্ষেত্রে সমস্যার মূলে প্রবেশ করে করা হয়। তাই তাকে বলে রুট কজ অ্যানালিসিস - আর সি এ।  
আর সি এ-র একটা স্বীকৃত পদ্ধতি হল ফাইভ হোয়াই অ্যানালিসিস। কেন? কেন? কেন? কেন? কেন?
একটা দরকারি ফিচার আমার ওয়েবসাইটে কাজ করছে না।  কেন? ঠিক মত কোড লেখা হয়নি, ঠিকমত টেস্টিং হয়নি। দ্বিতীয় ব্যাপারটা নিয়ে টেস্ট করে যারা তারা দেখবে। কিন্তু ঠিকমত কোড লেখা হয়নি। কেন? যে লিখেছে সে যথেষ্ট দক্ষ নয়। কেন? তাকে ঠিকমত ট্রেনিং দেওয়া হয় নি। কেন? যথেষ্ট সময় ছিল না। কেন? ঠিকমত প্ল্যান করা হয়নি। 
অর্থাৎ দেখুন, সমস্যাটা ব্যক্তি-কোডারের থেকে প্ল্যানিং এ চলে গেল। এবার এখানেও আমরা আবার ফাইভ হোয়াই চালাতে পারি, কিন্তু সে কথা থাক। 
আমরা দেখছি, ক্রমাগত দেখে চলেছি, বিভিন্ন জায়গায় ডাক্তাররা, শিক্ষকরা, ব্যাঙ্ককর্মচারীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। গ্রাহক বা ছাত্র বা রুগী ও তাঁর আত্মীয়পরিজনের ক্রোধ গিয়ে পড়ছে এদের ওপর। কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তি দোষী। কিন্তু সবক্ষেত্রেই? গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের যে ডাক্তারটি মার খেলেন, পরিকাঠামো না থাকার কারণে সময়মত চিকিৎসা করতে না পেরে মহকুমা হাসপাতাল রেফার করায় এবং পথেই রোগীর মৃত্যু হওয়ায়, তার কী দোষ? একশ কুড়ি জন ছাত্রীকে নিয়ে যে শিক্ষিকা উচ্চমাধ্যমিকের ক্লাস নিয়ে থাকেন, তার ক্লাসের অধিকাংশ ছাত্রী পাস না করলে, তার কী দোষ? আমরা ঠান্ডা মাথায় ভাবলে এগুলো বুঝি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই ঠান্ডা মাথায় ভেবে উঠতে পারি না তৎক্ষণাৎ। বরং আমার পবিত্র রাগ প্রকাশ করার জন্য আউটলেট খুঁজি। একটা স্ট্রম্যান। খড়ের পুতুল। যে পালটা দিতে পারবে না।  দুঘা দিয়ে দিই ওই ডাক্তারকে।  চেঁচামেচি করি সেই ব্যাঙ্ক কর্মচারীর ওপর যে আমাকে পাঁচ হাজার টাকা পাঁচ টাকার কয়েনে দিতে বাধ্য হল। People।
আমরা process দেখি না। কারণ হাতের কাছেই সহজলভ্য people। কিন্তু যদি দেখতাম? যদি একটা ফাইভ হোয়াই অ্যানালিসিস করেই নিতাম?
ডাক্তার চিকিৎসা করেননি। কেন? পরিকাঠামো নেই। কেন? যথেষ্ট অর্থ-সংস্থান হয়নি। কেন? স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কমেছে। কেন? সরকার টাকা খরচ করেছে বিজ্ঞাপনে। কেন? "কঠিন পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই।"
আপনার উত্তরগুলো আলাদা হতে পারে। এবং আপনাকে আরো অনেক বেশী 'কেন? হোয়াই?' এই প্রশ্ন করতে হতে পারে। তবে আপনি যদি লেগে থাকেন, পারবেন। আমিও পারব। বাস্তব আসলে একটি ওয়েবসাইট বানানোর থেকে অনেক কঠিন। কিন্তু মানুষ-ও তাঁর জীবন দিয়ে ঠিক বুঝে যান। 
যেমন গোরখপুরের মানুষ বুঝেছেন, ডাক্তার কাফিল খান নয়, আসল দোষী কে?
"Question everything"

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন